Press "Enter" to skip to content

জাতীয়তাবাদী রাজনীতি: ধর্ম ও ভাষার প্রভাব (সমাপ্ত)

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা
[গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা]
জাতীয়তাবাদের উপাদানগুলির মধ্যে পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বা প্রতিযোগিতা অনেক সময় স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত নিয়মে জনসাধারণের মতামতের ভিত্তিতে পরিচালিত হতে পারে। আবার কখনো কখনো শাসক গোষ্ঠী বা রাজনৈতিক দল কোন এক বা একাধিক উপাদানের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করে উপাদানগুলোকে বাইরে থেকে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করতে পরে।

বিভিন্ন সময়ে শাসকগোষ্ঠীরা কোন একটি জাতির নিজস্ব পরিচয় বদলে ভিন্ন পরিচয় দেয়ার চেষ্টা করেছে। সেখানে কিছু শাসকগোষ্ঠীর কোন কোন প্রচেষ্টা হয়তো সফল হয়েছে, কিন্তু তা বেশী দিন স্থায়ী ও কার্যকর হয় নি।

প্রাচীন কাল হতে অদ্যাবধি জাতীয়তা বোধ বা জাতিসত্তার প্রশ্নে শাসকগোষ্ঠীরা চাপ বা শক্তি প্রয়োগ করে এসেছে বা আসছে। বিশেষ করে জাতীয়তার ক্ষেত্রে এমন চাপের সমস্যাটি আরো বেশী প্রবল আকার ধারণ করে, যেখানে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা অনুপস্থিত বা উপস্থিত থাকলেও তা দুর্বল ও অকার্যকর ।

স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে ’৭২ সালের জনপ্রতিনিধি প্রণীত সংবিধানে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তা বা ঐক্যের বদলে যে ভাষাভিত্তিক বাঙালী জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করা হয়, তা অল্প কিছুদিনের মধ্যে পূর্বের ধর্মীয় পরিচয়ের জায়গায় ফিরে আসে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মধ্য দিয়ে।

বিষয়টি যে শুধু নেহায়েত সংবিধান সংশোধনের প্রক্রিয়া ছিল তা কিন্তু নয়। এটা ছিল ভাষা-কেন্দ্রিক বাঙালী জাতির পরিচয় নতুন করে বদলে নেওয়ার প্রক্রিয়া। তৎকালীন শাসক গণ কর্তৃক সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে জাতিসত্তার মৌলিক পরিবর্তন ঘটে। সংবিধানের মূলনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে আসা হয়।

সংবিধানের অন্যতম মূলনীতি- ধর্ম নিরপেক্ষতার পরিবর্তে কোন এক বিশেষ ধর্মের প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন করা হয়। ভাষা-কেন্দ্রিক ব্যাপক ঐক্যের জায়গা থেকে কম ব্যাপক ধর্মীয় ঐক্যের জায়গায় জাতিকে পুনরায় ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়।

অর্থাৎ ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে বাঙালী জাতির যে নতুন জাতিসত্তা গঠিত হয় তা পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে অনেকটা ম্লান ও দুর্বল হয়ে পড়ে। ভাষাগত ব্যাপক ঐক্যের জায়গাটিতে বেশীরভাগ মানুষের ধর্ম এসে আবারো প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে।

সংবিধানের মূলনীতির এই যে পরিবর্তন, তা কারো কাছে সামান্য বিষয় বলে মনে হতে পারে। কিন্তু এর প্রভাব যে কত সুদূরপ্রসারী ও ব্যাপক হতে পারে তা কল্পনার অতীত।

পঞ্চম সংশোধনীর সুস্পষ্ট প্রভাব হিসাবে রাজনৈতিক মতাদর্শ, দল বা গোষ্ঠীতে আবারও ধর্মীয় চেতনা যুক্ত হয় এবং তা দিনে দিনে আরও সমৃদ্ধ হতে থাকে এবং ভাষা কেন্দ্রিক বাঙালী জাতীয়তাবাদ বদলে মানচিত্র ভিত্তিক বাংলাদেশী জাতীয়তা প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

সম-সাময়িক বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক কার্যকলাপে জাতীয়তাবাদের ধর্মীয় উপাদানের এ রকম গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব আরো বেশী জোরদার করা হয় সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মধ্যে দিয়ে।

সংবিধানে বেশীরভাগ মানুষের ধর্মের প্রাধান্য স্বীকার করে নেয়, যার ফলে রাজনৈতিক মতাদর্শ বা চিন্তায় আরো বেশী ধর্ম প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। কোন কোন ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদের ধর্মীয় উপাদানের বাড়াবাড়ি এতটা উদ্বেগের পর্যায়ে যেতে শুরু করে যে, কিছু ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ করা প্রায় কঠিন হয়ে পড়ে।

কিছু অতি-ধর্মাশ্রয়ী কট্টর দল বা গোষ্ঠীকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় এবং প্রচলিত আইন ও সংবিধান লঙ্ঘন করার জন্য তাদের শাস্তি প্রদান করা হয়।

বাঙালী জাতির জাতীয়তাবোধ নামক চেতনার জায়গাটিতে এমনভাবেই এদেশের বেশীর ভাগ মানুষের ধর্ম ও ভাষা প্রভাব বিস্তার করেছে এবং আজও তা করে চলেছে।

জাতীয়তার অন্যান্য উপাদানের চেয়ে সম-সাময়িক রাজনৈতিতে ধর্ম ও ভাষার প্রভাব অস্বীকার করবার নয়। বরং এ দুটি উপাদানের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে বাঙালী জাতি আজকের জায়গায় পৌঁছেছে।

আরো পড়ুন:

জাতীয়তাবাদী রাজনীতি: ধর্ম ও ভাষার প্রভাব

জাতীয়তাবাদী রাজনীতি: ধর্ম ও ভাষার প্রভাব-২

2 Comments

    মন্তব্য করুন

    আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

    twelve − 8 =