চিন্তা, অবধারণ ও ভাষা: প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

চিন্তা, অবধারণ ও ভাষা

মানুষ অন্যান্য প্রাণী থেকে অনন্য এ জন্য যে, মানুষেরই কেবলমাত্র বুদ্ধি আছে যার ফলশ্রুতিতে সে চিন্তা করতে পারে। আর চিন্তাশক্তি থাকার জন্যই মানুষ ধ্বনি উচ্চারিত ভাষার মধ্য দিয়ে, একদিকে যেমন সে তার নিজের চিন্তাকে অন্যদের কাছে তুলে ধরতে পারে, অন্যদিকে তেমন অন্যের চিন্তাপ্রসূত ভাষাকে বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে গ্রহণ করে, প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে।

ভাষা মানুষের চিন্তার সাথে গভীরভাবে সম্পর্কীত এবং ভাষা ছাড়া চিন্তা বা চিন্তা ছাড়া ভাষা একেবারেই অসম্ভব। মানুষ যখন কোন বিষয়ে চিন্তা করে তখন তা ভাষার সাহায্য নিয়েই করে থাকে। আবার কোন বিষয়ের চিন্তা, কোন না কোন ভাষার মধ্য দিয়েই প্রকাশিত হয়।

চিন্তা মানুষের এমন এক মানসিক শক্তি, যার সাহায্যে সে তার ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে চারপাশের প্রকৃতি ও প্রকৃতির মাঝে অবস্থিত বিভিন্ন বিষয়বস্তু সম্পর্কে অভিজ্ঞতা লাভ করে অসংখ্য ধারণা গঠন করতে পারে। শুধু তাই নয়, মানুষ ধারণাগুলোকে পরস্পরের সাথে তুলনামূলক বিচার-বিশ্লেষণ করে সেগুলিকে একত্রীকরণ বা পারস্পরিক সংযুক্তি করণের মাধ্যমে, এক একটি অবধারণ বা মানসিক বাক্যে উন্নীত করতে পারে।

অবধারণ হল, চিন্তা ও ভাষার মাঝখানের অতি প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। এটিকে ভাষার মানসিক রূপ বা ভাষার প্রস্তুতি পর্ব বা আঁতুড় ঘর বলা যায়। মানুষ তার অবধারণ গুলোর প্রকাশ-মাধ্যম হিসাবে তার মুখের ভাষা যেমন ব্যবহার করে, তেমন তা তার আচরণ বা অঙ্গভঙ্গির মধ্য দিয়ে প্রকাশ করতে পারে।

ভাষা যেমন অবধারণের পরবর্তী ধাপের প্রকাশ, তেমন মানুষের চিন্তার সাথে আচরণও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বিশেষ করে মানুষের ঐচ্ছিক আচরণ তার চিন্তা ও চিন্তার উপাদান গুলির সাথে সম্পর্কিত।

মানুষের মনে বিভিন্ন বিষয় সম্বন্ধে অজস্র ধারণা থাকে। মানুষ জন্মের আগে থেকেই কিছু ধারণা অর্জন করে আসে , না অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে পরবর্তীতে ধারণা গুলি অর্জন করে তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, মানুষ তার ধারণাগুলোকে সাথে নিয়ে বড় হয় ও পথ চলে।

‘ধারণা (Concept) হল অর্থের বোধগত একক। এটিকে জ্ঞানের এককও বলা হয়। ধারণা মানুষের মনের বিমূর্ত একটি বস্তু। এটিকে ভাষা বা প্রতীকের সাহায্যে উপস্থাপন করা হয়।’ অর্থাৎ, ধারণা হল, কোন বিষয়বস্তুর প্রতিরূপ বা ছাপ যা মনের মধ্যে অবস্থান করে। ধারণা গুলি এক একটি বিষয়ের অভিজ্ঞতা যা বর্তমানে বা পূর্বে কোন এক সময় ব্যক্তি অর্জন করে। এক্ষেত্রে চিন্তার আরেকটি উপাদান স্মৃতি, ধারণাগুলোকে সংরক্ষণ করে রাখে এবং প্রয়োজনে অবধারণ গঠনের সময় তা সরবরাহ করে।

অবধারণ (Judgement) হল, কমপক্ষে দুটি ধারণার মধ্যে তুলনামূলক সম্পর্কের মানসিক প্রকাশ। অবধারণের মাধ্যমে ধারনা গুলির মধ্যে স্বীকৃতি বা অস্বীকৃতির সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত দুই বা ততোধিক ধারণাকে তুলনা করে , হয় ধারণা দুটিকে স্বীকার করা হয়, না হয় অস্বীকার করা হয়।

যখন মানুষের সামনে কমপক্ষে দুটি ধারণা উপস্থিত হয় তখন সে ধারণা দুটি নিয়ে তুলনামূলক বিচার-বিশ্লেষণ করে, ধারণা দুটিকে স্বীকৃতি বা অস্বীকৃতির পর্যায়ে নিয়ে যায়। যেমন: ফুল, পারদ, সুন্দর, কঠিন ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে কিছুটা ধারণা মানুষের থাকেই।

দুই বা ততোধিক ধারণাকে মনে-মনে সংযুক্ত করতে যেয়ে, মানুষ কোন সময় তাদের মধ্যকার সম্পর্ককে স্বীকার করে, আবার কোন সময় অস্বীকার করে। ‘ফুল’ ও ‘সুন্দর’-এ দুটি ধারণার মধ্যে সম্পর্ক স্বীকার করে, সে মনে মনে ভাবে যে, ‘ফুল হয় সুন্দর।’ আবার ‘পারদ’ ও ‘কঠিন’-এ দুটি ধারণা মধ্যে সম্পর্ককে অস্বীকার করে ভাবে যে, ‘পারদ নয় কঠিন’। সুতরাং অবধারণ একটি মানসিক প্রক্রিয়া এবং তা মনের মধ্যেই সংঘটিত হয়।

কিন্তু এক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে, মানুষের মানসিক স্তরে সংগঠিত কোন একটি অবধারণ বা মানসিক বাক্য যদি ভাষার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত না করা হয়, তাহলে তা মানসিক স্তরেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। এক্ষেত্রে অবধারণ কে প্রকাশ করতে কোন একটি ভাষার সাহায্য নিতে হয়।

অর্থাৎ, অবধারণ নামক মানসিক বাক্যটি কোন একটি ভাষার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়। যখন মানুষ কোন বিষয়বস্তু সম্পর্কে কোন কিছু বলে, তখন সেটা নিছক অবধারণেরই প্রকাশমাত্র। অবধারণের প্রকাশিত রূপকে বাক্য বলে, যা ভাষার প্রধান উপাদান।

এখানে বলে নেওয়া ভাল যে, ব্যাকরণের বাক্য গুলির মধ্যে কেবল বর্ণনামূলক বা ঘোষক বাক্যই কোন কিছুর চিন্তা প্রকাশ করতে পারে। অন্য বাক্য গুলির দ্বারা মানুষের আবেগ-উচ্ছাস, ইচ্ছা-অনিচ্ছা, বিস্ময় ইত্যাদি প্রকাশিত হয় বলে সেগুলি চিন্তা ও অবধারণ প্রকাশে সমর্থ নয়।

তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, মানুষ ধ্বনি উচ্চারিত ভাষার মধ্য দিয়ে মনের ভাব প্রকাশের জন্য যে বাক্যসমূহ প্রকাশ করে তা আসলে কোন না কোন অবধারণেরই বহিঃপ্রকাশ, যার মধ্যে একাধিক ধারণার একত্রীকরণ বা সংযুক্তিকরণ রয়েছে।

মানুষের ভাষাগত প্রকাশ কতটা যুক্তিযুক্ত হবে তা নির্ভর করে যুক্তিযুক্ত অবধারণ গঠনের উপর। যদি অবধারণ গঠনের সময় সঠিক নিয়মে ধারণা গুলির একত্রীকরণ বা সংযুক্তিকরণ করা হয়, তাহলে ভাষার মধ্য দিয়ে মানুষ সঠিক চিন্তার প্রতিফলন ঘটাতে পারে। আর ধারণা গুলি একত্রীকরণে ব্যর্থতা, চিন্তা ও ভাষাকে অর্থহীন করে তোলে।

আরো পড়ুন:

মূল্য কে কি মানুষই মূল্যবান করে তোলে?

দর্শন ও দার্শনিক | Philosophy and philosopher

মৃত্যু: জীবনের সমাপ্তি, না অসীম যাত্রার শুরু?

মন্তব্য করুন

5 × two =