Press "Enter" to skip to content

গণতন্ত্রের একাল-সেকাল

গণতন্ত্রের একাল-সেকাল

রাষ্ট্র দর্শনের আদর্শ হিসাবে গণতন্ত্র বিশেষ স্থান ও স্বাতন্ত্র্যের অধিকারী। আদর্শ হিসাবে গণতন্ত্র বয়সে সুপ্রাচীন। কার্যত যখন থেকে মানুষের সমাজ জীবনের সূচনা হয়েছে তখন থেকেই মানুষ গণতন্ত্র সম্পর্কে চিন্তাভাবনা শুরু করেছে এবং এর পক্ষে ও বিপক্ষে তারা তাদের মতবাদ পেষ করেছে।

গণতন্ত্রের সর্বপ্রথম প্রচলন ও বিকাশ প্রাপ্ত হয়েছে খৃ: পূ: যুগে গণতন্ত্রের সূতিকাগার নামে কথিত গ্রীক নগর রাষ্ট্র এথেন্সে। প্রাচীন কাল থেকে শুরু করে অদ্যাবধি পর্যন্ত গণতন্ত্র বিভিন্ন যুগে বিচিত্রভাবে উদ্ভাসিত হয়েছে এবং মানুষের আশা-আকাঙ্খা পূরণে কখনও সফল হয়েছে আবার কখনও ব্যার্থ হয়েছে।

তবে গণতন্ত্র তার চলার পথে কতটুকু সফল হয়েছে তা বিতর্ক সাপেক্ষ হলেও গণতন্ত্র যে একেবারেই ব্যার্থ হয়েছে তা আমরা বলতে পারি না।

গণতন্ত্র সর্বপ্রথম প্রচলিত হয় প্রাচীন গ্রীসে। তবে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, খৃ: পূ: পঞ্চম শতকে নগর রাষ্ট্র এথেন্সে যে অবস্থায় গণতন্ত্রের প্রসার ঘটে তা বর্তমানে অনুপস্থিত। তুলনামূলক দেখতে গেলে গ্রীসের নগর রাষ্ট্রগুলোর আয়তন ও লোকসংখ্যার দিক হতে বিংশ শতকের অধিকাংশ রাষ্ট্র অপেক্ষা অনেক ক্ষুদ্র ছিল।

গ্রীসের নাগরিক সমাজ তাদের গণতন্ত্রকে গর্বের বস্তু বলে মনে করতেন। এথেন্সবাসীরা তাদের গণতন্ত্রের প্রতি কিরূপ শ্রদ্ধাশীল ছিলেন তার পরিচয় পাওয়া যায় থুসিডাইসি কর্তৃক উদ্ধৃত পেরিক্লিসের উক্তি হতে “আমি বলতে চায় আমাদের শাসন পদ্ধতি কোন প্রতিবেশী রাষ্ট্রের নিকট হতে ধার করা হয় নাই। আমরা অপরকে অনুকরণ করি নাই বরং অপরে আমাদের পদ্ধতিকে আদর্শ বলে মেনে নিচ্ছে।”

কিন্তু এথেনীয় গণতন্ত্র দীর্ঘকাল স্থায়ী হতে পারে নাই। এর কারণ এই হতে পারে যে, যাদের উপর শাসন ব্যাবস্থা ন্যাস্ত ছিল তারা অনেকে ছিল অনভিজ্ঞ এবং অশিক্ষিত। দার্শনিক প্লেটো এ গণতন্ত্রের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তার কারণ হয়তো এথেনীয় গণতন্ত্রী কর্তৃক তার গুরু সক্রেটিসের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দান হতে পারে।

খৃ:পূ: ৩১২ সনে কোরোনিয়ার যুদ্ধে মেসিডনের রাজা ফিলিপের নিকট এথেন্স পরাজয় বরণ করে। প্রকৃতপক্ষে কোরোনিয়ার যুদ্ধের সাথে সাথে গণতন্ত্রের আদি যুগেরও অবসান ঘটে।

মধ্যযুগে জ্ঞান বিজ্ঞান ও স্বাধীন মত প্রকাশের ক্ষেত্রে অন্ধকার যুগ বলে বিবেচিত। কারণ মধ্যযুগে ধর্ম ও চার্চ তাদের নিয়ন্ত্রণে সব কিছুই নিয়ে নেন, ফলে ধর্ম ও চার্চের স্বার্থে প্রাচীন কালের অর্জিত অনেক মূল্যবান জিনিস আমাদের হারাতে হয়। এই যুগে ইউরোপে গীর্জার স্তরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা ও সামন্ততন্ত্রের প্রসারণের দারুন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অস্তিত্ব একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়।

তবে তখনকার দিনেও কিছুটা গণতান্ত্রিক ভাবধারা উপস্থিত ছিল- একথা বলা যায়। উদাহরণ স্বরূপ মধ্যযুগে ইংলান্ডের আইনের শাসন ও গণতান্ত্রিক জুরি প্রথা প্রচলিত ছিল বলে সাধারণ মানুষ আত্ম অধিকার রক্ষাকল্পে আদালতের শরণাপন্ন হতে পারত।

তাছাড়া মধ্যযুগের শেষ ভাগে গীর্জার অভ্যন্তরীন অনাচার ও দূর্ণীতির বিরুদ্ধে ইউরোপ ব্যাপী যে কনসিলিয়ার আন্দোলন শুরু হয় তা হতে কিছু কিছু গণতান্ত্রিক ভাবধারার আভাষ পাওয়া যায়।

আইনের সার্বভৌমত্ব, সন্মতি ভিত্তিক শাসন এবং শাসনতন্ত্রবাদের স্বপক্ষে কনসিলিয়ন বাদী চিন্তাবিদগণ অত্যন্ত সোচ্চার ছিলেন। তবে একথা সত্য যে, গণতন্ত্রের ভাবধারা মধ্যযুগে দু’এক আলোকচ্ছটায় উদ্ভাসিত হলেও মধ্যযুগ ছিল গণতন্ত্রের পক্ষে অন্ধকার যুগ।

গণতন্ত্রের ব্যাপক প্রসার ও চর্চা পরিলক্ষিত হয় আধুনিক কালে। অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে সমগ্র ইউরোপে এর প্রভাব বিস্তৃত হয়। গ্রেট ব্রিটেন, জেনিভা, অষ্ট্রিয়া, নেদারল্যান্ড ও মার্কিন উপনিবেশ সমূহে এর ক্রমশ শিকড় বিস্তার লাভ করতে থাকে এবং ফরাসী বিপ্লবের মধ্য দিয়ে এর চরম সাফল্য সূচিত হয়।

অষ্টাদশ শতকের গণতান্ত্রিক ভাবধারার উৎস স্থল হিসাবে প্রধানত ইংল্যান্ডকে চিহ্নিত করা যায়। রাজার স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে যারা সেখানে পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব কায়েমের জন্য আন্দোলন করেন। এক হিসাবে তারাই ছিলেন গণতন্ত্রের অগ্রদূত।

ইংলান্ডের বিশিষ্ট চিন্তানায়কেরাও এ ব্যাপারে পশ্চাদ্পদ ছিলেন না। গণতন্ত্রের সমর্থনে তারাও অনেক গ্রন্থ রচনা করেন।এদের মধ্যে জন লক এর নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য, কেননা তিনিই ছিলেন আধুনিক গণতন্ত্রের জনক। তিনি তার Of civil government গ্রন্থে তিনি গণতন্ত্রের ভিত্তি সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন যে, সরকার ও শাসিতের সম্পর্ক সমাজচুক্তি বুনিয়াদের উপর প্রতিষ্ঠিত।

এই চুক্তি অনুযায়ী জনগণ সরকারকে শাসনাধিকার দিয়েছে এবং যদি সরকার চুক্তি বিরোধী কাজ করে তবে জনগণ বিপ্লবের সাহায্যে সরকার পরিবর্তনের অধিকার রাখে।

জন লক-এর মতবাদ আমেরিকার স্বাধীনতাকামী জনগণকে বিপূলভাবে প্রভাবিত করেছিল। বস্তুত: জেফারসনের ‘স্বাধীনতা ঘোষণা’ মূলে লক এর ভাবধারার প্রভাব বিদ্যমান।

এভাবে গণতন্ত্র আধুনিক যুগে তার পদচারণা শুরু করে সগৌরবে। তবে অনেক জাতি গণতন্ত্রের ধ্বজা সমুন্নত রাখতে ব্যার্থ হয়েছে। অনেকে আবার গণতন্ত্রের ধারা বজায় রাখতে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে।

বাঙালী জাতি ১৯৭১ সালে গণতন্ত্র রক্ষার প্রয়াসে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে গণতন্ত্রের বিজয় পতাকাকে সমুন্নত রাখার প্রচেষ্টা চালিয়েছে। তাছাড়া বিশ্ববাসীও আজ গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখার প্রচেষ্টায় প্রাণপণ চেষ্টায় নিয়োজিত।

আরো পড়ুন:

জন স্টুয়ার্ট মিল : গণতন্ত্রের প্রবক্তা অথচ অনিচ্ছুক গণতন্ত্রী

স্বাধীনতা কে অর্থহীন বলা, স্বাধীনতা কে অস্বীকার করার নামান্তর

One Comment

    মন্তব্য করুন

    আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

    1 × three =