Press "Enter" to skip to content

বিশ্বাসের বিরোধিতা ও ধর্মে-ধর্মে ব্যবধান

বিশ্বাসের বিরোধিতা

বিশ্বাসের বিরোধিতা কি  ধর্মে-ধর্মে ব্যবধান তৈরী করেছে?

মানুষ কিছুটা হলেও স্বাধীন চিন্তা করতে পারে বলে, জাগতিক বিষয় ভাবনার সাথে সাথে অতি জাগতিক বা অতীন্দ্রিয় ভাবনায় কখনো সে আছন্ন হয়ে পড়ে। মানুষ মরণশীল হবার কারণে, জগতে জন্মেই সে তার স্থান খোঁজার চেষ্টা করে।

জগতে মানুষের ক্ষুদ্র অবস্থানের কারণে সে তার চেয়ে বৃহৎ কোন কিছুর কাছে নত হতে বাধ্য হয়েছে কালে-কালে। তার চেয়ে বৃহৎ জাগতিক বা অতি-জাগতিক কোন কিছুকে স্বীকার করে নিতে সে বাধ্য হয়েছে তার সসীম চরিত্রের কারণে।

প্রকৃতিতে যখনই সে তার চেয়ে বড় ও শক্তিশালী কোন কিছু দেখেছে তখনই তার সন্তুষ্টির জন্য উপাসনা করে এসেছে বংশানুক্রমিক ভাবে। দৃশ্যমান জগতের অন্তরালে মানুষের চেয়ে বড় কিছু স্বীকার করা না হলে যেহেতু চিন্তার ক্ষেত্রে শূন্যতার সৃষ্টি হয়, সেহেতু এই শূন্যতার পূরণে মানুষ সচেষ্ট থেকেছে সব সময়। আর শূন্যতা পূরণের চেষ্টায় মানুষ কোন না কোন ধর্মীয় বিশ্বাসের অনুসারী হয়ে জীবনযাপন করেছে পরম কল্যাণের লক্ষ্যে।

ধর্ম আগে এসেছে না পরে প্রবর্তিত হয়েছে তা নিয়ে যদি আমরা চিন্তা নাও করি, বা সোজা কথায় এমনটি বলি যে, পৃথিবীতে ধর্ম বিশ্বাসীর সংখ্যা অবিশ্বাসীর চেয়ে অনেক-অনেক বেশী।

মানুষ প্রাগ-ঐতিহাসিক কাল থেকে কোন না কোন ধর্ম ও মতের অনুসারী হয়ে জীবন-যাপন করে এসেছে। তাদের বিশ্বাসে যদিও কোন কোন ক্ষেত্রে ভিন্নতা ছিল তবুও একথা জোর দিয়ে বলা যেতে পারে যে, সকল ধম বিশ্বাসীরাই অতি-প্রাকৃতিক বা অতীন্দ্রিয় সত্তা, আত্মা, অমরত্ব বিষয়ে বিশ্বাস করতো মনে-প্রাণে।

এ বিশ্বাসের কারণ স্বয়ং মানুষের স্বভাবজাত চিন্তাশক্তি বা ধী-শক্তির মধ্যেই নিহিত আছে। মানুষ তার স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যের কারণে যুগে-যুগে পিতৃ-পুরুষের ধর্ম ও বিশ্বাসকে পরম কল্যাণের লক্ষ্যে বংশানুক্রমিক লালন-পালন করে এসেছে ।

ধর্মের লক্ষ্য হল সকলের সর্বাঙ্গীন কল্যাণ বা পরম কল্যাণ, কিন্তু কোন সময় তা ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের হীন স্বার্থে ব্যবহৃত হবার ফলে ধর্মে-ধর্মে ব্যবধান ও বৈষম্য সৃষ্টি করে। যার ফলশ্রুতিতে ভিন্ন ধর্মবিশ্বাসীদের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে যায়।

যদিও ধর্মের লক্ষ্য মানুষের পরম কল্যাণ, কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিন্নতা বা ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যেকার স্বার্থের ভিন্নতার জন্য, ধর্মে-ধর্মে ব্যবধান জনিত কারণে সংঘাত অনিবার্য হয়ে পড়ে। পরম কল্যাণের লক্ষ্যে পরিচালিত বংশানুক্রমিক ধর্মীয় চিন্তাধারার মধ্যে যখন নিজ গোষ্ঠী ও দলের স্বার্থ মাথা তুলে দাঁড়ায় তখন সে বিশ্বাসের বিরোধিতা বা দ্বন্দ্ব শুধু মানুষের বিশ্বাসে বা মানসিক স্তরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না বরং তা ভিন্ন ধর্মের সাথে সংঘাত সৃষ্টি করে।

এ জাগতিক দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের পিছনে যত না ধর্মীয় মত-পার্থক্য ও বিশ্বাসের প্রাধান্য থাকে, তার চয়ে বেশী থাকে কোন না কোন রাজনীতি দল ও গোষ্ঠীর স্বার্থের প্রাধান্য।

মানুষের বিশ্বাস যেহেতু মানসিক ব্যাপার এবং কিছু চিন্তাশীল মানুষ স্বাধীন ভাবে চিন্তা করতে পছন্দ করে বলে, কোন এক ধর্ম বা ধর্মীয় বিশ্বাস কালের বিবর্তনে ও যুগের প্রয়োজনে কিছু কিছু করে সবার অগোচরে পাল্টে যেতে থাকে। কিন্তু কিছু মানুষ ধর্ম ও ধর্মীয় বিধি গুলি অপরিবর্তনীয় বলে বিশ্বাস করার কারণে স্থান, কাল ও পাত্র-ভেদে একই ধর্ম অনুসারীদের মধ্যেও ধর্ম-বিশ্বাসে ও মতের অমিল বা দ্বন্দ্ব দেখা দেয় ।

মানুষে-মানুষের বিশ্বাসের অমিল বা দ্বন্দ্ব যে কেবলমাত্র ভিন্ন ধর্ম-বিশ্বাসীদের সাথেই একমাত্র সংগঠিত হয় এমনটি ভাবা সঙ্গত নয় বরং একই ধর্মের অনুসারীদের মধ্যেও বিশ্বাসে তারতম্য থাকেই। এই বিশ্বাসের দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের ফলশ্রুতিতে, মানুষ যে সমাজে বাস করে তার উপাদান গুলির মধ্যেও নিয়ত পরিবর্তন চলতে থাকে বলে, সামাজিক উপাদান গুলির অনেক কিছুই পাল্টে যায়। সমাজবদ্ধ জীব হিসাবে পাল্টে যায় মানুষের মূল্যবোধ ও নৈতিকতা।

বলপ্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠান হিসাবে রাষ্ট্রের গোড়াপত্তনের পর থেকে এই পাল্টে যাওয়ায় গতিটা আরও বেড়ে গেলে ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও দ্বন্দ্ব শুরু হয়। আইন, ধর্ম ও নৈতিকতার এমন সংঘর্ষে রাষ্ট্র ও শাসকগোষ্ঠীর প্রণীত নীতি গুলি এ বিশ্বাসের দ্বন্দ্বে, কোন ধর্ম ও বিশ্বাসকে প্রাধান্য দিয়ে একদিকে যেমন আগুনে ঘি ঢেলেছে, অন্যদিকে তেমন একই সমাজ ও রাষ্ট্র বসবাসরত মানুষের বিশ্বাসের মত-পার্থক্য কমানোর লক্ষ্যে অবশ্যই পালনীয় আইন-কানুনও প্রণয়ন করেছে ।

রাষ্ট্র যদিও সমাজবদ্ধ মানুষের সর্বাঙ্গীন কল্যাণের লক্ষ্যে, বেশীরভাগ মানুষের সম্মতিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে মনে করা হয়, কিন্তু বল প্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠান হিসাবে তাকে যে ক্ষমতা গুলি দেওয়া হয়েছে, কখনো কখনো তার অপব্যবহারে কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণ হওয়া সম্ভাবনা বেশী সৃষ্টি হয়।

রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠী তার নিজ স্বার্থে বা বেশীরভাগ মানুষের স্বার্থে যখন কোন ধর্মীয় বিশ্বাসকে লালন ও অন্য ধর্ম বিশ্বাসকে এড়িয়ে যেতে বা দমন করতে থাকে, তখন বিশ্বাসের বিরোধিতা বা সংঘাত ব্যক্তি মানুষের মানসিক স্তর থেকে সামাজিক আচরণে দিকে ধাবিত হতে থাকে।

মানুষে-মানুষের এই বিশ্বাসের দ্বন্দ্ব বা বিশ্বাসের বিরোধিতা আরও প্রকট হয়ে উঠে যখন কোন একটি ধর্ম রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে যায়। রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পেতে থাকলে কোন একটি ধর্মীয় বিশ্বাস সমাজ ও রাষ্ট্রের অপরাপর বিশ্বাসের উপর প্রাধান্য বিস্তার করার চেষ্টা করে এবং তখনই বিভিন্ন ধর্ম বিশ্বাসীদের মধ্যে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে পড়ে।

ধর্মে-ধর্মে ব্যবধান ও সংঘর্ষের ঘটনা যতটা ধর্মীয় বিশ্বাস দ্বারা প্রভাবিত হয় তার চেয়ে বেশী প্রভাবিত হয় রাষ্ট্র ও শাসকগোষ্ঠীর স্বার্থের দ্বারা। রাষ্ট্র ও তার শাসকগোষ্ঠীর স্বার্থের কাছে মানুষের স্বাধীন চিন্তা-চেতনা ও বিশ্বাস যেমন ভূলুণ্ঠিত হয় তেমন রাষ্ট্র মানুষকে দাসে পরিণত করে।

আরো পড়ুন:

মৃত্যু: জীবনের সমাপ্তি, না অসীম যাত্রার শুরু?

মৃত্যু ভয় ও ধর্ম | Fear of death and religion

Be First to Comment

    মন্তব্য করুন

    আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

    thirteen + three =