Press "Enter" to skip to content

সুখী হতে কে না চায়?

সুখী হতে কে না চায়?

ভারতীয় চার্বাক সম্প্রদায়ের মতে, সুখ বা সুখভোগ মানুষের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। তবে তাদের ভাষায় ”সুখের জন্য, ঋণ করে হলেও ঘি ভাত খাও’- কথাটি পুরোপুরি মানতে না পারলেও একথা সত্য যে, মানুষ মাত্রেই সুখী হতে চায় এবং দুঃখ পরিহার করতে চায়।

সুখী হতে কে না চায়?

যা মানুষের পক্ষে সুখদায়ক তা ভাল আর যা সুখের পরিপন্থী তা মন্দ কাজ। সুখের অনুভূতি গুলি মানুষের অস্তিত্বের জন্য প্রয়োজনীয় বলে, সেগুলোকে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে এবং দুঃখের অনুভূতি গুলি মানুষের অস্তিত্বের পক্ষে সহায়ক নয় বলে সেগুলিকে এড়িয়ে চলে।

যদিও মানুষের একমাত্র লক্ষ্য হল সুখ লাভ করা, কিন্তু কখনো সে তার কর্মপন্থা নির্বাচনের অক্ষমতা বা ভুল নির্বাচনে দ্বারা সুখ লাভে বঞ্চিত হয় এবং দুঃখের সাগরে পতিত হয়। এ যেন কবির ভাষায়, ‍‌”সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু অনলে পুড়িয়া গেল/ অমিয়া সায়রে ছিনান করিতে সকলি গরল ভেল।”

এখানে বলে রাখা ভাল যে, মানুষের সুখ-দুঃখের অনুভূতি একান্তই ব্যক্তিনির্ভর। সুখ এক প্রকার মানসিক অনুভূতি বলে ব্যক্তিতে-ব্যক্তিতে এর মূল্যায়নও আলাদা। মানুষ সব সময় তার নিজের সুখ চায়। তবে মানুষ যে একেবারে নিজের সুখের জন্যই সব সময় সব কিছু করে -এমনটা না ভেবে বরং সে নিজ সুখ লাভের পাশাপাশি অন্যের সুখের জন্যও তার সকল আচরণ ও কর্ম পরিচালনা করে-এমনটা ভাবাই যুক্তিসঙ্গত।

সুখ মানুষের মনের এমন এক মৌলিক অনুভূতি যার সংজ্ঞা দেওয়া যায় না। মৌলিক কোন জিনিস অনন্য বলে বা অন্য কারও সাথে তুলনা করা যায় না বলে, তার সংজ্ঞায়নও সম্ভব নয়। তবে একে বিভিন্নভাবে বর্ণনা করা যেতে পারে। সুখানুভূতিতে ব্যক্তিমানুষের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও এমনটি বলা যায় যে, সুখ এক প্রকার মানসিক অনুভূতি যেটা মানুষ একান্তভাবে কামনা করে এবং যা না পেলে বা যার অনুপস্থিতিতে সে দুঃখিত হয়।

সুখের অনুপস্থিতিকে দুঃখ আর  দুঃখের অনুপস্থিতিকে সুখ বলা যায় কী না- তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় পোষণ করা গেলেও, সুখ-দুঃখের অনুভূতিকে অস্বীকার করার উপায় তো নেয়ই বরং মানুষের সমগ্র জীবনই সুখের লক্ষ্যেই পরিচালিত হয়।

এমন কি কোন কাজের নৈতিক মূল্যায়নের মানদণ্ড হিসাবেও সুখবাদীরা সুখকে মূল্যায়ন করেছেন। কোন কাজ সুখকর বলে তা করা ভাল।  আর কোন কাজ সুখ উৎপন্ন না করে যদি দুঃখ উৎপন্ন করে তাহলে তা মন্দ কাজ হিসাবে বিবেচনা করা হয় এবং সে কাজ করা অনুচিত। মানুষের আচরণের উচিত-অনুচিত-এর প্রশ্নেও সুখ এক মুখ্য ভূমিকা পালন করে।

যদি আমরা সুখকে মানুষের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ও সকল কর্মের নৈতিক বিচারের মানদণ্ড হিসাবে গ্রহনও করি, তাহলে প্রশ্ন জাগে- সুখের মধ্যে কি কোন গুনগত ও পরিমাণগত পার্থক্য নেই?

আবার, মানুষ কি কেবলই তার নিজের সুখের জন্যই সব কিছু করে, না পরের সুখের জন্যও কিছু করতে বাধ্য হয়। মানুষ যদি শুধু নিজের সুখ লাভের জন্য চিন্তা করে তাহলে পরোপকার বা পরের জন্য মানুষ তার জীবন বিসর্জন দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেন না কেন?

প্রশ্নগুলোর উত্তর অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে নীতিশাস্ত্রের মানুষের নৈতিক জীবনের আদর্শ ও লক্ষ্য হিসাবে সুখবাদ নিয়ে কিছুটা আলোচনা করা যাক। নীতিদর্শনের ইতিহাসে সুখবাদের প্রচারক হিসাবে জেরেমি বেনথামজন স্টুয়ার্ট মিল এর  মতে, মানুষ কেবলই সুখ চায়। মানুষ যেহেতু সুখ চায় সেহেতু সুখের লক্ষ্যেই তার সকল কর্ম পরিচালিত হওয়া উচিত।

তবে বেনথামের মতের সাথে মিলের মতের কিছুটা পার্থক্য থাকলেও উভয়েই সুখকে নৈতিক জীবনের আদর্শ ও লক্ষ্য হিসাবে মনে করেন। বেনথাম এর মতে, মানুষের আচরণের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে এটা প্রতীয়মান হয় যে, মানুষ স্বভাবগত কারণে সুখ পেতে আগ্রহী। মানুষ তার নিজের সুখের জন্যই সকল কর্মে নিয়োজিত হয়।

মানুষের কাছে সব চেয়ে প্রিয় বিষয় হল তার নিজের সুখ। তিনি মানুষের আচরণ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন। তিনি আরও মনে করেন যে, সুখের মধ্যে তীব্রতা বা পরিমাণের দিক থেকে পার্থক্য আছে। সব সুখ সমানভাবে তীব্র নয় বরং কোন সুখ অতি তীব্র এবং কোন সুখ তীব্রতার বিচারে অত তীব্র নয়।  শারীরিক সুখের মত মানসিক সুখগুলো বেশী তীব্র নয়। ক্ষুধার্ত অবস্থায় খাদ্যগ্রহণের সুখ যতটা তীব্র, ততটা সুন্দর কোন প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার সুখ নয়।

কিন্তু মিল-এর চিন্তাধারা লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, বেনথামের সুখ সম্পর্কিত মতবাদের সাথে কিছু বিষয়ে তিনি একমত পোষণ করলেও, বেনথাম সুখের যে পরিমাণগত পার্থক্যের কথা বলেছেন তার সাথে তিনি সুখের গুনগত দিক দিয়েও পার্থক্য আছে বলে স্বীকার করেছেন, এবং মানুষ তার নিজের সুখের সাথে সাথে অপরের সুখের কথা চিন্তা করে বলেও মতামত প্রকাশ করেছেন।

মিলের মতে, সুখের যেমন পরিমাণগত পার্থক্য রয়েছে তেমনই পার্থক্য রয়েছে গুনের দিক থেকেও এবং স্থায়িত্বের বিচারেরও উভয় সুখের মধ্যে পার্থক্য লক্ষণীয়। শারীরিক সুখ তীব্র হলেও মানসিক সুখের স্থায়িত্ব বেশী এবং এর প্রতি তিনি গুরুত্ব আরোপ করেছেন।

তার মতে, “সুখী শূকরের চেয়ে, অসুখী সক্রেটিস হওয়া ভাল।” শুধু শারীরিক ভোগবিলাসে ব্যস্ত ব্যক্তিরূপ প্রাণীর চাইতে মানুষ আরও কিছু পেতে চায় বলে, শুধু দেহেরই নয় বরং মানসিক সুখের জন্যও সে চেষ্টা করে। কেননা, মানুষ শুধু প্রাণীই নয় বরং সে বুদ্ধিমান প্রাণী বলে, দেহের সুখের পাশাপাশি মনের সুখও প্রয়োজনীয় বলে মনে করে। একটি ভাল খাবার স্বাদ গ্রহণের সুখের চাইতেও কোন প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার সুখের স্থায়িত্ব বেশী এবং তা উচ্চস্তরের সুখ।

মানুষ উচ্চস্তরের প্রাণী হওয়ার খাতিরে শুধু বুদ্ধিহীন প্রাণীদের মত নিজের সুখ নিয়ে ব্যস্ত থাকবে বা শুধু নিজের সুখই কাম্য-বস্তু হিসাবে মনে করবে তা কিন্তু নয়, বরং সে বেশীরভাগ মানুষের কল্যাণের লক্ষ্যে কাজ করবে এবং সেটাই তার লক্ষ্য হওয়া উচিত। এখানে তিনি ‘সর্বাধিক লোকের সর্বাধিক সুখ’ কে  নৈতিক জীবনের আদর্শ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছেন।

যে কাজ সর্বাধিক লোককে সর্বাধিক সুখ দেবে তা ভাল কাজ হিসাবে পরিগণিত হবে এবং যে কাজ সর্বাধিক লোকের দুঃখ আনয়ন করবে তা মন্দ কাজ এবং সেটা মানুষের পরিহার করা উচিত।

যদিও সর্বাধিক লোকের সর্বাধিক সুখের চাইতে, সকল মানুষের সুখই নৈতিক জীবনের আদর্শ ও লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু সকল মানুষকে সুখী করা সম্ভব নয়।  সুখ-দুঃখের অনুভূতির বিষয়টি আলো-আঁধারের মত সাপেক্ষ বিষয় বলে একটি ছাড়া অন্যটি আর্থহীন। কারণ দুঃখের অবর্তমানে সুখের কোন মূল্য নেই, যেমন মূল্য নেই আঁধার ছাড়া আলোর।

যদিও পৃথিবীর সকল মানুষকে একসাথে সুখী করা নাও যায়, তবুও মানুষ যদি সর্বাধিক লোকের বেশী-বেশী সুখ কামনা করে এবং তা পাওয়ার লক্ষ্যে তার কর্ম ও আচরণকে পরিচালিত করে, তাহলে এই ধূলির ধরণীতে স্বর্গ নেমে আসতেও পারে।

আরো পড়ুন:

মূল্য কে কি মানুষই মূল্যবান করে তোলে?

মৃত্যু: জীবনের সমাপ্তি, না অসীম যাত্রার শুরু?

Be First to Comment

    মন্তব্য করুন

    আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

    2 × 1 =