Press "Enter" to skip to content

ভাষা বিড়ম্বনা: প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

ভাষা বিড়ম্বনা

আমরা যখন কেউ বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করি তখন জন্মসূত্রে দু’টি ভাষার মালিক হয়ে যাই সম্পূর্ণ বিনামূল্যে, আরেকটিকে অবশ্য পরবর্তীতে অর্জন করতে হয়। জন্মানোর পরেই একটি শিশুকে তার ধর্মের ভাষা আরবি‘কে গ্রহণ করতে হয় মাকে ভালবেসে। কারণ আমাদের দেশের বেশীরভাগ মা বাংলাভাষী বলে।

মা-বাবারা যেহেতু এক-একজন ব্যক্তি মানুষ তাই তাদের একটি নির্দিষ্ট ধর্মও থাকে। আমাদের দেশের বেশীর ভাগ মানুষই ধর্মে দিক দিয়ে মুসলিম বলে, আরেকটি ভাষা আমাদের শিখতে হয় ধর্ম পালনের জন্য। তা না শিখলে আমাদের এবাদত-বন্দেগিতে মারাত্মক অসুবিধা হতে পারে, যা পরকালে ক্ষতির কারণ হতে পারে।

মাকে ভালবেসে আর পরকালের ক্ষতির হাত থেকে বাঁচতে, প্রথমতঃ আমরা মায়ের মুখের ভাষা ‘বাংলা’ শিখি মায়ের কোলে বসে, দ্বিতীয়তঃ মা-বাবার ‌’ধর্মের ভাষা আরবি’ শিখি পরকালের অনন্ত জীবনের কথা ভেবে।

পরবর্তীতে অবশ্য আরেকটা ভাষা শিখতে আমরা অনেকটা বাধ্য হই। সে নির্বাচন অবশ্যই ঐচ্ছিক। আমরা চাইলে তা অর্জন করতে করতে পারি, না চাইলে না। বলছিলাম ইংরেজি ভাষার কথা।

ভাষাটি আমাদের শিখতে হয় কর্ম করার জন্য। বিশ্বের বহুল প্রচলিত ভাষা এটা। ভাষাটির সার্বজনীনতা ভাষাটিকে করে তুলেছে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ভাষা। শিখলে ফায়দা অনেক। জাগতিক উন্নতির সম্ভাবনা আছে। পরকালের কল্যাণের পাশাপাশি একালেও আমরা ভাল থাকতে অর্থাৎ বিত্ত-বৈভব কম আশা করি না।

এক্ষণে তিনটি ভাষা শেখা আমাদের উপর অবশ্য কর্তব্য হয়ে পড়লো। একটিকেও ছাড়া যাবে না। আমরা ইহকালের বিত্ত-বৈভবের পাশাপাশি, পরকালের কল্যান সহ রক্তে রঞ্জিত মায়ের মুখের ভাষা বাংলাকে ছাড়তে রাজী নই। এখন আমাদের উপর যে ভাষাগুলো শেখা অতি প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়ালো তা কোথায় শেখা যাবে?

উত্তরে, গড়ে উঠল বিভিন্ন মান ও মাত্রার শিক্ষা পদ্ধতি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বিশেষ করে তিনটি ভাষার উপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে গিয়ে গড়ে উঠলো শিক্ষার বিভিন্ন মাধ্যম। যেমন: ইংরেজী মাধ্যমের শিক্ষা, সাধারণ শিক্ষা, মাদ্রাসা শিক্ষা ইত্যদি।

কিন্তু এতগুলো মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণে আমাদের ভাষাগত দক্ষতা নিঃসন্দেহে বাড়ার কথা। কারণ বেশী মাধ্যমে শিখতে পারলে আমরা বেশী কিছু শিখতে পারবো।

কিন্তু বাস্তবে ভাষা শিক্ষা ভাষা বিড়ম্বনা জনিত কারণে কি ভয়াবহ ঘটনা ঘটে চলছে, তা শিক্ষার সাথে জড়িত ব্যক্তিরা কিছুটা অনুভব করতে পারবেন। আমাদেরকে যদি ‘বাঁচা, মরা আর মায়ের’ তাগিদে তিনটি ভাষা শিখতে হয় (অনেকটা বাধ্য হয়ে), তাহলে আমরা যে কোন ভাষা নিশ্চিতভাবে ভাল শিখতে ও দক্ষতা দেখাতে পারবো না, তা বোধ হয় জোর দিয়ে বলা যায়।

ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রটিতে ভাষার আধিক্য জনিত কারণে যে বিষয়সমূহ ঘটে চলেছে তা সত্যিই ভয়াবহ ও ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কেবল ভাষাগত আধিক্যের জন্য আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিষয় গুলোকে কেটে-ছেঁটে অনেকটা ছোট করে পাঠক্রম প্রস্তুত করতে হয়, যা শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য কিছুটা হলেও ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

শিক্ষার প্রধান প্রধান মাধ্যমগুলোতে শিক্ষার্থীদের ভাষাগত বিড়ম্বনা বিদ্যমান। শিক্ষার অন্যান্য মাধ্যমের চেয়ে বিশেষ করে মাদ্রাসা শিক্ষায় সমস্যাটা আরো বেশী গুরুতর। সেখানে তিনটি ভাষা (বাংলা, ইংরেজী, আরবী) শিক্ষার্থীদের বাধ্যতামূলক শেখানোর চেষ্টা করা হয়। ভাষার আধিক্যে সেখানকার পাঠ্যক্রমে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিষয় গুলিকে যেমন সীমিত পরিসরে রাখা হয়, তেমনি শিক্ষার্থীদের ভাষাগত দক্ষতার ঘাটতি দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়।

আবার সাধারণ শিক্ষা মাধ্যমেও এমন ভাষাগত বিড়ম্বনা বিদ্যমান। এখানকার শিক্ষার্থীদেরও অন্ততপক্ষে দুটি ভাষার (বাংলা, ইংরেজী) যাঁতাকলে পিষ্ট হতে হয়। এখানকার শিক্ষার্থীদের ভাষাগত দক্ষতা যে খুব ভাল তা জোর দিয়ে বলা যাবে না । বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার যে হারে শিক্ষার্থীরা অকৃতকার্য হয় তার প্রধান কারণ এই দুটি ভাষা।

ইংরেজী বি-জাতীয় ভাষা বলে শিক্ষার্থীদের তা রপ্ত করতে সমস্যা হয়। আর বাংলা আমাদের মায়ের মুখের ভাষা বলে, আমরা মনের ভাব প্রকাশ করতে পারলেও সঠিক বাংলা বলতে, লিখতে জানা লোক সমাজে হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র।

ইংরেজী শিক্ষা মাধ্যমে ভাষাগত বিড়ম্বনা বা ভাষার আধিক্য তেমন নেই বললেই চলে। কিন্তু এখানে খুব বেশী ভাষা আধিক্য বা জটিলতা না থাকলেও, আমাদের মায়ের ভাষা বাংলার সব চাইতে সর্বনাশা ক্ষতি তারা করে চলেছেন। শুনেছি সেখানকার শিক্ষার্থীরা ভাল করে বাংলায় কথা বলতে পারে না।

তারা নাকি বাংলায় কথা বলতে অভ্যস্ত বা আগ্রহী নয়। ভয়ঙ্কর ভয়ের কথা। সেখানকার শিক্ষার্থীরা যদি বাংলা ভুলে যায়, অন্য ভাষার প্রতি বিশেষ ভালবাসা দেখাতে গিয়ে, তাহলে এদেশ কি একভাষী থেকে বহুভাষী দেশে পরিনত হবে?

ভাষার ভিন্নতার মাধ্যমে কি বাঙালী জাতীয়তাবাদ একদিন ধ্বংস হবে? এমনিতে আমরা জাতিগতভাবে অনৈক্যে ভুগছি। শিক্ষা মাধ্যম গুলি যদি আমাদের মধ্যে ঐক্যের বদলে ঐক্য হীনতা প্রতিষ্ঠা করে তাহলে এদেশের ভবিষ্যৎ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা একটু ভেবে দেখা দরকার।

এমনই অনেক ভয়াবহ ঘটনা ঘটে চলেছে আমাদের বিভিন্ন মাধ্যমে ভাষা শিক্ষার মধ্যে। ভাষার বাহুল্যতা জনিত কারণে দক্ষতার অভাবে, আমরা দিনে-দিনে জ্ঞান-বিজ্ঞানের কাছ থেকে ছিটকে পড়ছি। এখন আমরা বেশী বেশী ভাষা শিখবো না ভাষা সংখ্যাকে সীমিত করে জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতি বেশী মনোনিবেশ করবো, তা নিয়ে ভাবনার সময় এসেছে।

এখনই বিষয় গুলি নিয়ে না ভাবলে দেশটি অচিরে একটা শংকর ভাষাভাষী সমাজ ও বৈষম্যে জর্জরিত জনগোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করবে যা দেশের মধ্যে সংঘাতময় পরিস্থিতির জন্ম দেবে।

আরো পড়ুন:

ভাষা-সংস্কার: প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

One Comment

    মন্তব্য করুন

    আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

    1 + 18 =