প্লেটোর বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ নতুন নয়। অনেক আগে থেকেই তার বিরুদ্ধে কিছু পণ্ডিত তার মতবাদকে খণ্ডিতভাবে উপস্থাপন করে, তাঁকে কবি বিদ্বেষী একজন দার্শনিক হিসাবে অভিহিত করার চেষ্টা করেন, যা আমাদের নতুন করে ভাবনায় ফেলে দেয়।
কিন্তু কেন তিনি তৎকালীন কবিদের তার কল্পিত আদর্শ রাষ্ট্র ব্যবস্থায় রাখতে চান নি বা নির্বাসনে পাঠাতে চেয়েছেন, তা বুঝতে গেলে তৎকালীন গ্রীক নগর রাষ্ট্রসমূহের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক অবস্থা ও তৎকালীন কবি ও কবিতা সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাগুলো নিয়ে আলোচনার দাবী রাখে।
তখনকার দিনে গ্রীক কবি ও কবিতা সম্পর্কে প্রচলিত যে ধারণা ছিল তাতে স্বাধীন চিন্তার ধারক-বাহক প্লেটোর পক্ষে কবি সম্পর্কে এর চেয়ে বেশী ভাবা সঙ্গত ছিল না। কারণ তৎকালীন কবি ও কবিতা সম্পর্কে গ্রীকদের ধারণা ছিল আজকের চেয়ে ভিন্ন।
তারা মনে করতো যে, কবি ও কবিতা একটা দৈব সত্তা এবং তা সব কিছুর উর্দ্ধে -যা ছিল প্লেটোর স্বাধীন চিন্তার বিরোধী। একজন স্বাধীন চিন্তার মানুষের কাছে কোন কিছুই যুক্তি-তর্কের উর্দ্ধে নয়।
প্লেটো নিশ্চয় স্বীকার করতে চাইবেন না যে, কবির কোন কবিতা আলোচনা উর্দ্ধে এবং সেটিই শেষ কথা। গ্রীক মহান কবি হোমার নিঃসন্দেহে কালোত্তীর্ণ কবি। কিন্তু তাই বলে তার কবিতা সব কিছুর উর্দ্ধে এমন ভাবা প্লেটোর পক্ষে সঙ্গত ছিল না।
তাই তিনি তার আদর্শ রাষ্ট্রে সব কিছুর উর্দ্ধে স্থান দিয়েছেন দার্শনিক রাজাকে। যিনি একদিকে হবেন প্রচুর জ্ঞানী অন্যদিকে হবেন প্রখর নেতা। তিনি হবেন বীর, বিচক্ষণ, সাহসী সহ সকল সদগুণের অধিকারী।
তৎকালীন গ্রীক সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বীরত্ব বা বীর্যকে সর্বোচচ গুণ হিসাবে বিবেচনা করা হতো। কেননা, প্রতিটি গ্রীক নগর রাষ্ট্রকে পার্শ্ববর্তী প্রতিদ্বন্দ্বি রাষ্ট্রের আক্রমন থেকে বাঁচার জন্য যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হতো। ‘জোর যার মুল্লুক তার’-এই ছিল তখনকার নীতি।
তাই তিনি তার আদর্শ রাষ্ট্রে সবার উর্দ্ধে রেখেছেন একজন জ্ঞানী বীরকে যিনি প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রকে বহিঃশত্রুর হাত থেকে রক্ষা করতে সমর্থ হবেন। তার জন্য তিনি সৈনিক শ্রেণীর উপর জোর দিয়েছেন। দার্শনিক রাজার কাজ হলো সৈনিক শ্রেণীর সহায়তায় রাষ্ট্রকে বহিঃশত্রুর হাত থেকে রক্ষা করবেন এবং রাষ্ট্রের সব শ্রেণী পেষার মানুষের জন্য ন্যায় প্রতিষ্ঠা করবেন।
প্লেটো তার আদর্শ রাষ্ট্রে তৎকালীন কবিদের এজন্য স্থান দিতে চান নি যে, কবি ও কবিতা সম্পর্কে প্রচলিত ধারণার সাথে তিনি একমত ছিলেন না আবার তখন কবিতা দিয়ে যুদ্ধের সময় ছিল না। একেবারে ‘পারলে মার, না হলে মর’ -এরূপ অবস্থা। প্লেটোর গুরু সক্রেটিস কে এথেন্সকে রক্ষার জন্য সম্মুখ সমরে যেতে হয়েছিল। সে যুদ্ধে তিনি ও তার সহযোদ্ধারা পরাজিত হয়ে ফিরে আসেন।
তাহলে বুঝতেই পারছেন যে, প্লেটো কেন তৎকালীন কবিদের সুনজরে দেখেন নি। তিনি যদি তৎকালীন কবিদের তার আদর্শ রাষ্ট্র সবার উর্দ্ধে রাখতেন, তবে তা হত তৎকালীন নিয়ম বিরোধী ও হাস্যকর।
তবে আজকের দিনে এই বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবা যেতে পারে। প্লেটোর কবি ও কবিতা সম্পর্কিত ধারণা তৎকালীন ধারণার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। কিন্তু বর্তমানে কবিকুল ও তাদের কবিতা এমন একটা মানে পৌছেছে যে, তারা শুধু কবিই নন ববং তারা কবি ও দার্শনিক।
আজকের কবিগণ প্রতিনিয়ত শব্দ ও ছন্দে যে জীবনদর্শন মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছেন তা যদি প্লেটো দেখে যেতে পারতেন তাহলে কবি সম্পর্কে তার ধারণা ভিন্নরূপ হতে পারতো।
আরো পড়ুন:
দর্শন ও দার্শনিক | Philosophy and philosopher
[ছবিসূত্র : উইকিপিডিয়া]
মন্তব্য করা বন্ধ রয়েছে।