Press "Enter" to skip to content

যখন আমি ভূত ছিলাম!

Pramanik Jalal Uddin
[Pramanik Jalal Uddin]

তখন আমার বয়স কতই বা হবে। বড়জোর আট-দশ। বাবা-মায়ের আট সন্তানের মধ্যে আমি দ্বিতীয়। অনেক সন্তান বলে মা আমাদের খুব একটা সময় দিতে পারতেন না। আমরা মাকে খুব জ্বালাতন করতাম। বিশেষ করে আমি ছিলাম সবচেয়ে দুষ্টু; বদের শিরোমণি। বেশী জ্বালাতন করলে মা মারতেন। আমি অবশ্য বেশী জ্বালাতন করার সুবাদে বেশী মার খেতাম। মায়ের হাতের মার খাবার অল্পক্ষণ পর তা ভুলে গিয়ে আবার জ্বালাতন; আবার মার খাওয়া। এইভাবে কেটেছে আমার ছোট (শিশু) জীবন।

আমি দুটো বিষয়ে সর্বাধিক মার খেতাম। একটি হলো খাবারের সময় মাছের মাথা  নিয়ে জেদ, আর অন্যটি হলো চুরি করে খাবার খাওয়া। মাকে না জানিয়ে চুরি করে বেশী বেশী খাবার খাওয়া ছিলো নিত্য দিনের কাজ এবং সেটা ছিলো প্রায় নেশার মতো। মা যতোই দিক, চুরি করে খাবারটি খাওয়া চায়ই চাই। না খেলে পেট পরবে না। বেশীর ভাগ সময় সফল হলেও কখনো কখনো মায়ের হাতে ধরা পড়ে যেতাম। ভাগ্যে থাকতো তখন নির্ঘাত মার। একবারতো চুরি করে খেজুরের লালী গুড় খেতে গিয়ে আস্ত কয়েকটা তেলাপোকা কচকচ করে চিবিয়ে খেয়ে ফেলেছিলাম। সেই কথা একটু বলি।

বৈশাখের মাঝামাঝি সময়। আমাদের নিজের খেতের নতুন গম উঠেছে। নতুন গমের রুটি খেতে খুব মজা। তার সঙ্গে যদি একটু খেজুরের লালীগুড় হয় তাহলে তো সোনায় সোহাগা। মা আমাদের সবাইকে সকালে খেজুরের লালীগুড় দিতে রুটি খেতে দিলেন। আমি বেশীর জন্য জেদ করলাম, মা আমাকে সবার চেয়ে একটু বেশীই দিলেন। তবুও আমার মন উঠলো না। আমি ভালোভাবে দেখতে লাগলাম মা কোথায় লালীগুড়ের হাড়িটা রাখেন। আমি গোয়েন্দার মত মায়ের পিছু লেগে রইলাম।

অবশেষে মা গুড়টা উপর তলার ঘরে রেখে তালা মেরে নিচে এসে চাবিটা আলমারির উপরে গোপনে রাখলেন। আমিও ছিলাম তক্কে তক্কে। যেই মা রান্না ঘরের দিকে গেলেন অমনি চাবিটা নিয়ে উপর তলায় উঠলাম। চুরি করে গুড় খেতে লাগলাম। কিন্তু খেতে গিয়ে দেখলাম, গুড়ের দলাবাঁধা দানা হাড়ির নিচের দিকে আছে। আমি আস্ত একটা রুটি ভাঁজ করে হাড়ির নিচ থেকে দানা উদ্ধারের জন্য নামালাম। তারপর রুটিটিকে দলা পাকিয়ে ওপরে তুলে এনে মনের সুখে খেতে লাগলাম। ওমা! যখন খেতে শুরু করলাম তখন দেখি গুড়ের দানার গন্ধটা যেন কেমন কেমন লাগছে। মনের মধ্যে সন্দেহ দেখা দিলো।

আবার কয়েকবার চিবুলাম। না, গন্ধটা ঠিক লালী গুড়ের দানার মত বলে মনে হচ্ছে না। মুখ থেকে গুড়ে ভর্তি চিবানো রুটিটা বের করে তো চোখ ছানাবড়া। একি চিবচ্ছিলাম এতক্ষণ! এতো গুড়ের দানা নয়! এ যে আস্ত কয়েকটা তেলাপোকা! যা কতক খেয়ে ফেলেছি। গা টা গুলিয়ে উঠলো। বমি হবে বোধহয়। অনেক চেষ্টা করলাম বমিকে আটকাতে। যদি মায়ের হাতে ধরা পড়ে যাই। কিন্তু পারলাম না। হড়হড় করে যা খেয়েছিলাম তা বেরিয়ে এলো। তার সঙ্গে গোটাকতক তেলাপোকাও। মা বমি করার শব্দ শুনতে পেয়ে টের পেলেন। আমাকে ধরে ফেললেন। পিঠে কয়েক ঘা পড়তেই দিলাম ছুট…………..

মায়ের হাতের কয়েকটা মার পিঠে পড়তেই আমি দিলাম ভোঁ দৌড়। দৌড়াচ্ছি, দৌড়াচ্ছি আর দৌড়াচ্ছি। কতক্ষণ দৌড়েছিলাম তা ঠিক মনে করতে পারছি না। তবে যখন হুস হলো তখন আমি নিজেকে আমাদের গ্রামের পার্শের বিলে আবিষ্কার করলাম। হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। যা হোক, এখন আমি মায়ের হাত থেকে অনেক দূরে।

বিলের ধারে একটা বটগাছের নিচে কিছুক্ষণের জন্য বসে পড়লাম। অনেক ধকল গেছে। একেতো তেলাপোকা খেয়ে বমি করে শরীরটা প্রায় নিস্তেজ তার উপর আবার মায়ের হাতের মার খেয়ে প্রায় মাইল খানেক দৌড়ানো। বসে বসে অনেক কিছু ভাবতে লাগলাম আর নিজেকে অনেক করে গালি দিতে লাগলাম। কি দরকার ছিলো চুরি করে লালী গুড় খাওয়ার? খেতে গিয়ে তো যত বিপত্তি। ভাগ্যে জুটলো গোটা কতক তেলাপোকা চিবানো আর মায়ের হাতের মার।

ভাবতে ভাবতে গাছের নিচে ঘুমিয়ে পড়লাম। বোধ হয় অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম। যখন ঘুম ভাঙ্গলো তখন প্রায় বিকেল। পেটে তখন প্রচণ্ড খিদে। খিদের জন্য উঠে দাড়াতে পারছিলাম না। সেই সকালে গোটা দু’য়েক রুটি খেয়েছিলাম। তাতো তেলাপোকা খেয়ে বমি করে সম্পূর্ণ উগলে ফেলেছি। কিন্তু কি আর করা। একদিকে পেটের জ্বালা অন্যদিকে মায়ের হাতের মার খাবার ভয়। ভাবতে ভাবতে প্রায় সন্ধ্যা। এখন কি হবে? আমি যাব কোথায়?

বাড়িতে গেলে মা মারবেন। আবার সন্ধ্যা নামতেই একাকী বিলে ভয় করতে লাগলো। ছোট মানুষ, ভয়তো লাগবেই। অনেক ভেবে-চিন্তে বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত নিলাম। ভাবলাম বাড়ি গিয়ে ঘরের কোথাও লুকিয়ে থাকবো। তারপর মায়ের রাগ একটু পড়লে মায়ের সামনে হাজির হবো।

বাড়ির পথে রওনা দিলাম। তখন পথ-ঘাট প্রায় অন্ধকার হয়ে এসেছে। বাড়ি পৌছাতে পৌছাতে প্রায় রাত। অনেকক্ষণ ওত পেতে থেকে অতি গোপনে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করলাম। যেন মা বা অন্য ভাই-বোন দেখতে না পায়। সফল হলাম। আমি দ্রুত বাড়ির মধ্যে ঢুকে লুকাবার জন্য গোপন স্থান খুঁজতে লাগলাম। একবার ভাবলাম ঘরের খাটের নিচে লুকায়।

পরে ভাবলাম, মা হয়তো দেখে ফেলতে পারে। আরেকবার ভাবলাম, ঘরে কাঠের বাক্স রাখা আছে তার মধ্যে ঢুকে পড়ি। না বাক্সতে লুকানো খুব একটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। যদি বাক্সের মধ্যে থেকে বের হতে না পারি। এসব ভাবতে ভাবতে চোখ পড়লো ঘরের কোনায় মুড়িয়ে রাখা ললপাটির (শীতলপাটির মত; তবে এটি অনেক শক্ত ও ভারী) দিকে। পাটিটি ঘরের কোনায় মুড়িয়ে দাড় করানো অবস্থায় আছে। ললপাটি মুড়িয়ে দাড় করিয়ে রাখলে তার মধ্যে কিছু ফাঁকা জায়গা থাকে। ভাবতে লাগলাম ললপাটির ঐ ফাঁকা জায়গায় লুকালে কেমন হয়। অমনি মায়ের গলা শুনতে পেলাম। মা আমাকে খুঁজছেন আর শাসাচ্ছেন। বাঁদরটা কোথায় গেছে, একবার পেলে হয়..।

চিন্তা করার আর সময় পেলাম না। দ্রুত ললপাটিটা ফাঁক করে নিজের শরীরটা ঢুকিয়ে ফেললাম। যাক বাঁচা গেল! মনে একটু শান্তি পেলাম। ললপটির ভিতর থেকেই মায়ের কথা-বার্তা শুনতে পাচ্ছিলাম। তখন আর ভয় পাচ্ছিলাম না এই ভেবে যে, মা আমাকে দেখতে পাবে না আর মারও খেতে হবে না। এই সব ভেবে মনকে যখন সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম তখনই ঘটলো যত বিপত্তি!

মা আমাকে শাসাতে শাসাতে ঘরের মধ্যে আসলেন বিছানা করার জন্য। আমরা অনেক ভাই-বোন। সবার বিছানা খাটে হয় না। তাই ঘরের মেঝেতে ললপাটি বিছিয়ে আমাদের শুতে হয়। মা যখন ললপাটিটি মেঝেতে বিছানোর জন্য টান দিলেন তখনই ঘটলো আসল ঘটনাটা। আমি ললপাটির মধ্যে থাকায় বুঝতে পারি নি।

যখন ললপাটি তে টান পড়লো তখন বুঝতে পরলাম মারাত্মক ভুল হয়ে গেছে। এখন মা বিছানা করবেন আর আমি ললপাটির ভিতর। এখনই ধরা পড়ে যাব। যখন ঢুকেছিলাম তখন বিষয়টা মাথায় আসেনি। মা ললপাটিটা টানছেন। কিন্তু ললপাটিটা আসছে না। আবার টানলেন। না আসছে না। এই ভাবে বার কয়েক টানলেন ললপাটিটি তাও আসলো না। আসবে কি করে ললপাটির মধ্যে যে আমি ঠায় দাড়িয়ে আছি। আমি থাকতে পাটিটি তার জায়গা থেকে আসছে না। তখন মা শেষ টানটি দিলেন আর আমিও খুব শক্ত করে ভিতর থেকে পাটিটি ধরে রাখলাম। মা হয়তো তখন কিছুক্ষণ ভাবলেন তারপর চিৎকার করে বললেন “ওরে বাবা আমার ঘরে ভূত” আর কিছু বলতে পারলেন না।

ভূতের ভয়ে মা আমার অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। আমি আরও ভয় পেয়ে গেলাম। একেতো চুরি করে লালীগুড় খেতে গিয়ে তেলাপোকা খেয়েছি তারপর আবার ভূত সেজে মাকে ভয় দেখাচ্ছি। এবার আর রক্ষা নাই। ঘরে কেউ আসার আগেই দ্রুত ললপাটির মধ্যে থেকে বের হয়ে অজ্ঞান মায়ের শরীরের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। আর জোরে জোরে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলাম “মা তোমার কি হয়েছে, তোমরা কে কোথায় আছ আমার মাকে বাঁচাও!”

আমার চিৎকার শুনে বাড়ির লোকজন এসে মায়ের মাথায় পানি ঢাললেন। চোখে-মুখে পানির ছিটা দেওয়াতে মার জ্ঞান ফিরে এলো।
চোখ মেলতেই মা বারবার বলতে লাগলেন “আমার ঘরে ভূত।”
বাড়ির লোকজন জানতে চাইলো “কোথায় ভূত?”
মা বললেন “ললপাটির ভিতর।”

বাড়ির সবাই গিয়ে ললপাটি তন্ন-তন্ন করে খুঁজে ভূতের সন্ধান পেলেন না। পাবে কি করে ? ভূতটি (আমি) তখন তো বাইরে সবার সাথে মায়ের আঁচল ধরে কাঁদছে। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। যাক বাবা, এ যাত্রায় বাঁচা গেল!

জ্যৈষ্ঠের মাঝামাঝি। বাড়ির বাগানের আম পাড়া হয়েছে। অনেক আম। মা আমাদের হাত থেকে আমগুলি বাঁচাতে ঘরের উপরের তালায় রেখেছেন। ঘরটি তালাবন্ধ। আমরা দু’ভাই চুরি করে আম খাওয়ার জন্য বুদ্ধি আঁটলাম। আমার বড় ভাই আমার চেয়ে বছর দু’য়েকের বড়। বড় হলে কি হবে। ওর ঘটে তেমন বুদ্ধি ছিলো না। আমার শরণাপন্ন হলেন। আমরা আমগুলি জানালার বাইরে থেকে দেখতে থাকলাম আর বুদ্ধি আটতে লাগলাম। কি করা যায়। তালার চাবিটা অনেক করে খুঁজলাম। পেলাম না।

অবশেষে আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। আমগুলি রাখা ছিলো জানালার ধারে। জানালাটা খোলা ছিলো। জানালা দিয়ে স্পষ্ট আমগুলিকে দেখা যায়। যদি আমরা এমন কিছু একটা পায় যেগুলি দিয়ে আমকে খোঁচা মেরে গেঁথে জানালার শিক গলিয়ে বাইরে নিয়ে আসতে পারি। অবশেষে বুদ্ধিটা পেয়ে গেলাম। নিচে এসে দু’ভাই কাজে লেগে পড়লাম।

একটা বাঁশের তিন-চারহাত কঞ্চি যোগাড় করলাম। তারপর দা দিয়ে তার একমাথা চোখা করলাম। মা আমাদের দেখে ফেললেন। আমরা যে কিছু একটা ফন্দি আঁটছি তা টের পেলেন। আমরা যথাসম্ভব সাবধান হলাম। যখনই মা আমাদের কাছ থেকে দূরে গেলেন অমনি আমরা আমাদের কাজে লেগে পড়লাম। চুপি-চুপি কাউকে না জানিয়ে ঘরের উপর তলায় উঠলাম। তালায় কাঠের পাটাতন। হাঁটলে শব্দ হয়। যথাসম্ভব পা টিপে-টিপে হাঁটছি। পাছে কোন শব্দ না হয়।

অবশেষে জানালার ধারে পৌঁছে গেলাম। বড়ভাইকে মাকে পাহারা দিতে রাখলাম। যেন ধরা পড়ে না যায়। আমি বাঁশের কঞ্চির সুচালো অংশটা জানারা গলিয়ে আমের কাছাকাছি পাঠাতে চেষ্টা করলাম। বার্থ হলাম। আরেকবার চেষ্টা করলাম। সফল হলাম। এবার কঞ্চির সুচালো মাথাটি আমকে খোঁচা মেরে গাঁথতে চেষ্টা করলাম। পারলাম না। আমগুলি খোঁচা খেয়ে দূরে সরে যাচ্ছে। বড় ভাই ছিলো পাহারায়। ও আমাকে ফিসফিসিয়ে তাড়াতাড়ি করতে বললো। আমি আপ্রাণ আমগুলিকে খোঁচাখুঁচি করে গাঁথতে চেষ্টা করতে লাগলাম।

যথাসম্ভব খুব তাড়াহুড়া করছিলাম। তাই খুট-খুট করে শব্দ হচ্ছিলো। মা টের পেয়ে আস্তে আস্তে আমাদের ধরতে উপরে উঠলেন। কখন যে মা আমাদের পিছনে এসে পড়েছিলেন আমরা টেরই পায় নি। বড় ভাইকে রেখেছিলাম পাহারায়। মায়ের দেখে বড় ভাই শুধু বলতে পারলেন-‘চল পালাই’।

ভাইয়ের আচমকা কথায় পিছনে তাকাকেই মাকে দেখতে পেলাম। বেশী ভাববার সময় পেলাম না। পালাতে হবে। পালাতে হবে। মাথাটা কিছুতেই কাজ করছে না। বুদ্ধি খাটাতে লাগলাম। বড়ভাইকে ততক্ষণে মা ধরে ফেলেছে। মা এক হাত দিয়ে বড় ভাইয়ের হাতটি ধরে অন্য হাতটি দিয়ে ভাইকে পেটাচ্ছেন। আমি এই সুযোগটি নিলাম। বাঁশের কঞ্চিটা ফেলে খুব করে একটা দৌড় লাগালাম। ধাক্কা খেলাম মার সঙ্গে। ধাক্কা খেয়ে মা পড়ে গেলেন। মা পড়ে গিয়ে চিৎকার করে বলতে লাগলেন ‘ভূতগুলো আমাকে মেরে ফেললো রে বাবা!’ অমনি আমরা দু’ভাই দে ছুট…………

আরো পড়ুন:

যে কথা কখনো কাউকে বলি নি

যখন আমি মানুষ হলাম

Be First to Comment

    মন্তব্য করুন

    আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

    15 − 4 =