
তিনি আইনশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসাবিজ্ঞান, ব্যকরণ, দর্শন প্রভৃতি বিষয়ে বহু মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। ‘পুলিয়াত’ নামক রচনা চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিকাশের পথকে উন্মুক্ত করে। দর্শন শাস্ত্রের উপর তার বিখ্যত গ্রন্থ ‘তাহ্ফাত-উত-তাহ্ফা (খণ্ডনের খণ্ডন) তার পূর্বসূরি আল গাজ্জালীর ‘তাহাফাতুল আল ফালাসিফা (দার্শনিক খন্ডন) গ্রন্থের জবাবে রচিত। এই গ্রন্থে তিনি দার্শনিকদের বিরুদ্ধে আনীত গাজ্জালী সহ অন্যান্য গোড়া ধর্মবিদদের অভিযোগের যুক্তিযুক্ত বিরোধিতা করেন।
আল গাজ্জালী যেখানে গ্রীক দর্শনের অশুভ প্রভাব থেকে ইসলামকে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন সেখানে ইবনে রুশদ এ্যারিস্টটলের দর্শন এর সাথে ইসলামী মতবাদের সমন্বয় ঘটানোর চেষ্টা করেছিলেন। তার অন্যান্য মতের সাথে আল্লাহর গুণাবলী সম্পর্কিত মতামত খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আল্লাহর গুণাবলী নিয়ে মুসলিম দর্শনের গোড়া থেকে ‘মুতাজিলা’ ও ‘আশারিয়া’ সম্প্রদায়ের মধ্যে বিতর্ক চলে আসছিল। মুতাজিলা সম্প্রদায় আল্লাহর একত্ব নষ্ট হবে বলে আল্লাহর যে ৯৯ টি গুণাবলী আছে বলে ধারণা করা হয় তা তারা অস্বীকার করেছিলেন বা তারা আল্লাহর গুণাবলীকে একটিতে নামিয়ে এনেছিলেন।
পক্ষান্তরে আশারিয়া সম্প্রদায় কোরআনে ঐশী গুণের উল্লেখ আছে বলে তা অস্বীকার করতে পারেন নি। গাজ্জালী আশারিয়াদের সমর্থন করে বক্তব্য রাখেন এবং পরবর্তীকালে ‘ইবনে সিনা’ মুতাজিলাদের সমর্থণ করে বক্তব্য রাখেন। ঐশী গুণাবলী সম্পর্কে ইবনে রুশদের মতামতের সাথে ইবনে সিনার মতের অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
ইবনে রুশদের মতে, কোন একটি সত্তার সূপ্ত অবস্থায় একাধিক গুণাবলী থাকা অসম্ভব নয়। কারণ সুপ্ত অস্তিত্ব সর্বদা পরিবর্তনশীল এবং সেই সাথে তার গুণাবলীও নিয়ত পরিবর্তনশীল। কিন্তু যা পূর্ণাঙ্গভাবে অস্তিত্বশীল তার কোন পরিবর্তন, পরিবর্ধন বা সংযোজন সম্ভব নয়।
আল্লাহ যেহেতু পরিপূর্ণ সত্তা এবং তা যুগ্ম সত্তা না হওয়ার কারণে আল্লাহ তার সারসত্তা ছাড়া অন্য কোন গুণ দ্বারা সমৃদ্ধ নয়। তার মতে আল্লাহর সত্তার বৈশিষ্ট এমনই যে তার ভিতরেই বিভিন্ন গুণাবলী অন্তর্নিহিত অবস্থায় থাকে এবং এই কারণে তার একাধিক গুণাবলী থাকা সত্ত্বেও আল্লাহ এক ও অভিন্ন।
আল্লাহর একক সত্তাকে আমরা বিভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে বিভিন্নভাবে গুণাবলীকে প্রত্যক্ষ করি। তাই আমরা তাকে বিভিন্ন গুণে ভূষিত করি। কিন্তু এই একাধিক গুণাবলী থাকা সত্ত্বেও আল্লাহ এক ও অভিন্ন সত্তার কারনে একাধিক হয়ে পড়েন নি।
ইবনে রুশদ ঐশী গুণাবলী ও জ্ঞানের সাথে মানবীয় জ্ঞান ও গুণাবলীর তুলনা করতে নারাজ। কারণ আল্লাহর জ্ঞান মানুষের জ্ঞানের মত জ্ঞেয় বস্তুর উপর নির্ভশীল নয়। আল্লাহর জ্ঞান মানুষের জ্ঞানের মত জ্ঞেয় বস্তুর উপর নির্ভরশীল হলে আল্লাহর জ্ঞান আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন সত্তা কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়বে। কিন্তু আল্লাহর ক্ষেত্রে জ্ঞান ও জ্ঞেয় বস্তু-এ দুটি বিচ্ছিন্ন নয়।
ইবনে রুশদের মতে আল্লাহর উপর কখনও ‘নরত্ব’ আরোপ করা যাবে না। কারণ ইসলামে আল্লাহর উপর নরত্ব আরোপকে চরমভাবে বিরোধিতা করা হয়েছে। এই নরত্বের গুণাবলী কালক্রমে ‘শিরকে’ পর্যবসিত হয়।
সুতরাং আল্লাহর একত্বের চরম সংরক্ষণের খাতিরে তিনি আল্লাহর গুণাবলীকে মানবীয় গুণাবলীর বহু উর্দ্ধে রাখতে চেয়েছেন। তাছাড়া আল্লাহ একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাক্ত সত্তা এং জড়ের উপাদানের উর্দ্ধে হওয়ার কারণে আল্লাহর গুণাবলী কখনও মানবীয় গুণাবলীর মত হতে পারে না। কারণ মানুষ ও অন্যান্য সৃষ্ট বস্তু অব্যক্ত এবং পরিবর্তনশীল।
কিন্তু এখানে একটি প্রশ্ন চলে আসে, কোরআনে যে আল্লাহর বিভিন্ন গুণের কথা স্বীকার করা হয়েছে তার কি হবে? এ প্রসঙ্গে ইবনে রুশদ বলেন, কোরআনে এই সব গুণাবলীর উল্লেখ দ্বারা এটাই বোঝানো হয়েছে যে, তিনি সব শক্তি ও ক্ষমতার অধিকারি। তিনি আরও বলেন, সাধারণ মানুষ আল্লাহর সুক্ষ ও জটিল রহস্য বুঝতে সক্ষম নয়, তাই রূপকচ্ছলে এই সব গুণাবলীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ জটিল তত্ত্বের চেয়ে এই সব উপমা সাধারণ মানুষের কাছে অধিক বোধগম্য।
আরো পড়ুন:
দর্শন ও দার্শনিক | Philosophy and philosopher
Be First to Comment