Press "Enter" to skip to content

আইন, ধর্ম ও নৈতিকতা: প্রাসঙ্গিক বিতর্ক

আইন, ধর্ম ও নৈতিকতা

আইন, ধর্ম ও নৈতিকতা সম্পর্কে কিছু বলার আগে আমাদের একটু অনুসন্ধান করে দেখা উচিত যে, এদের কোনটি কার পূর্বে এসেছে।

এখানে আমরা বিনা দ্বন্দ্বে একথা স্বীকার করতে পারি যে, আইন নিঃসন্দেহে ধর্ম ও নৈতিকতার পরে প্রচলিত হয়েছে। তাহলে এখন দ্বন্দ হলো, ধর্ম ও নৈতিকতা- কার পূর্বে কার আবির্ভাব গত অবস্থান? সমস্যাটা বেশ জটিল। তর্কটা বেশ জোরালো। এ তর্ক কিছুটা ‘ডিম আগে না মুরগী আগে’ তার মত।

তর্ক যেন কিছুতেই ফুরাতে চায় না। ধর্ম নৈতিকতার আগে এসেছে এর পক্ষে যেমন ভুরি-ভুরি যুক্তি আছে তেমনি নৈতিকতার আবির্ভার হয়েছে ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হবার বহু আগে এ মতেরও সমর্থণ জোরালো।

ধর্মের পক্ষে যারা তাদের মতে, সৃষ্টিকর্তা প্রথমে শূন্য থেকে জগৎ সৃষ্টি করেছেন, জগতে তার উপাসনার জন্য বান্দাদের (মানুষ) সৃষ্টি করেছেন এবং বান্দাদের মধ্যে তার প্রেরিত পুরুষ কর্তৃক সৃষ্টিকর্তার বানী অর্থাৎ অহির মাধ্যমে পাপ-পূণ্যের ধারণা দিয়েছেন। পরবর্তীতে ধর্মের পাপ-পূণ্যের ধারণা থেকেই ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় ধারণা উদ্ভব।

এ মতের মূল কথা হলো সৃষ্টিকর্তা জগৎ সৃষ্টি করে কিছু নিয়ম পালন করার কথা বলেছেন এবং কিছু কাজ থেকে বিরত থাকতে বলেছেন। এ যে বিরত থাকতে বলেছেন এবং কিছু নিয়ম পালন করতে বলেছেন-এ থেকেই পরবর্তীতে ভাল-মন্দ, উচিত-অনুচিতের উদ্ভব ঘটেছে।

অর্থাৎ নৈতিকতার জন্ম হয়েছে ধর্মীয় ধ্যান-ধারণা থেকে। তোমার এ কাজটা ধর্ম সম্মত অর্থাৎ তা ভাল এবং করা উচিত এবং তোমার এ কাজটা করা ধর্মের নিয়ম বিরুদ্ধ তাই এটি মন্দ এবং তা পরিহার করা উচিত।

এ মতের সোজা কথা হল এ মতে ধর্মীয় বিধি-বিধান থেকে যাবতীয় কিছুর উদ্ভব হয়েছে। নৈতিকতার আলাদা কোর স্থান নাই বরং তা ধর্মের পূর্বগামী নয় অনুগামী।

নৈতিকতার পক্ষের কথাগুলো এখন কিছু বলা যাক। জগতে যদি ভাল-মন্দ, উচিত-অনুচিত-এর অস্তিত্ব আগে স্বীকার করা না হয় তাহলে সব কিছুই মিথ্যা। মানব সমাজ আগে ভাল-মন্দ, উচিত-অনুচিত চিনতে শিখেছে এবং পরবর্তীতে ধর্ম এসে তা স্বীকার করে নিয়েছে।

সমাজের প্রচলিত উচিত-অনুচিতের কিছু ধ্যান-ধারণা প্রায় সকল ধর্মই মেনে নিয়েছে। কেননা তা ছিল তৎকালীন সমাজের দাবী। সমাজ বিমুখ কোন ধর্ম পৃথিবীতে দেখা যায় না। সমাজের বেশীর ভাগ মানুষ মনে করেছে যে, চুরি করা অনুচিত (চোর ব্যতিত) এবং তা মন্দ কাজ। তাই কোন ধর্মই চুরি করাকে বৈধ বলে স্বীকার করে নি।

অনুরূপভাবে মিথ্যা কথা বলাটা সমাজের চোখে যেমন অপরাধ তেমনি ধর্মের চোখেও পূণ্যের কাজ নয়। অর্থাৎ মোদ্দা কথা হলো, নৈতিকতার যতটুকু সার্বজনীনতা রয়েছে ধর্মের তা নেই। নৈতিকতার কিছু মানদণ্ড সবখানে প্রায় এক হলেও ধর্মে-ধর্মে প্রভেদ বিস্তর।

উদাহরণ স্বরূপ এক দেশে এক মাটিতে বাস করেও মুসলমানদের জন্য কিছু পশু খাদ্য হিসাবে খাওয়া হালাল বা পাপ কাজ না হলেও হিন্দু ধর্মালম্বীদের সেই পশু ভক্ষণ করা মহা পাপের কাজ।

কিন্তু সত্য কথা বলা, চুরি না করা উভয় ধর্মেরই কথা। এখানে কোন মত-পার্থক্য নেই। অর্থাৎ ধর্ম আগমনের বহু পূর্বে নৈতিকতার আবির্ভাব। ভাল-মন্দের ধারণা প্রকারান্তরে পাল্টে পাপ-পূন্যে পর্যবসিত হয়েছে। নৈতিকতা ধর্মের পূর্বগামী।

এখন আইন নিয়ে কিছু বলা যাক। আইনের জন্ম বা প্রচলন নিঃসন্দেহে ধর্ম ও নৈতিকতার পরে হয়েছে। মানুষ যখন রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠা করেছে তখনই রাষ্ট্রের অনুগামী হিসাবে আইনের জন্মলাভ ঘটেছে।

মানুষ যখন পরিপূর্ণ সামাজিক জীবন-যাপন করতে শুরু করেছে এবং সমাজের বেশীরভাগ মানুষ বা ক্ষমতাধর মানুষেরা সমাজ বা রাষ্ট্রে কে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যে বিধি বিধান বা নিয়ম-কানুন সৃষ্টি করেছে-তাই আইন।

আইন কোন সমাজ বা নির্দিষ্ট স্থানের নিয়ম-কানুন বা বিধি-বিধান। স্থানভেদে এর অনেক পার্থক্য বিদ্যমান। আইন মানুষকে এ জগতেই শাস্তির ব্যবস্থা করে সমাজ বা রাষ্ট্রের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে। এ ক্ষেত্রে এর নীতি হল বল প্রয়োগ।

রাষ্ট্র তার কিছু কায়দা-কানুন দ্বারা জনসাধারনকে বেআইনি কাজ থেকে বিরত রাখে সমাজ বা রাষ্ট্রের কল্যাণে। আইন অমান্য করলে তাকে বিচারের আওতায় এনে বেআইনি কাজের জন্য শাস্তি দেওয়া হয়।

কিন্তু লক্ষণীয় যে, ধর্ম ও নৈতিকতার বিধি বিধানগুলি অমান্য করলে জাগতিক শাস্তির তেমন ব্যবস্থা নাই। বেশীর ভাগ ধর্মে বলা হয়েছে এ জীবন তার পরের জীবনে মানুষের পাপ-পূন্যের বিচার হবে এবং তা করবেন সৃষ্টিকর্তা। আমাদের জাগতিক পাপ আর পূণ্য মিলে পরকালে আমাদের ভাগ্য নির্ধারিত হবে।

কিন্তু নৈতিকতার বিধি-বিধানগুলি মান্য না করা হলে সমাজ বড় জোর মন্দ বলবে, নিন্দার ঝড় উঠবে আর পালন করলে সাধুবাদ জানাবে। এখানে ব্যক্তির নৈতিকতা লংঘনের জন্য সামাজিক বয়কটতা ছাড়া আইনের মত শাস্তির কোন বিষয় নেই।

তাহলে দেখা যাচ্ছে যে আইনের প্রবল শক্তি আছে জনসাধারন কে বেআইনি কাজ থেকে বিরত রাখার ক্ষেত্রে কিন্তু ধর্ম ও নৈতিকতার এ রকম তেমন জোর নাই। এখানে বিস্তর স্বাধীনতা আছে ধর্ম ও নৈতিকতা পালন করা বা না করার।

এখন প্রশ্ন হলো, মানব কল্যাণের জন্য যে তিনটি উপাদান (আইন, ধর্ম ও নৈতিকতা) রয়েছে তার কয়টিকে গ্রহণ করা ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অপরিহার্য?

আইন, ধর্ম ও নৈতিকতা- এই তিনটি উপাদানই মানুষের জীবন রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয়। তবে কোনটি প্রয়োজনীয় আর কোনটি অবশ্যই পালনীয় আর কোনটি বা অল্প-প্রয়োজনীয় তা নির্ধারণ করবে এক একজন ব্যক্তি-মানুষ।

তবে আইন পালন করা সকল ব্যক্তি-মানুষের জন্য ব্যাধ্যতামূলক সকল গণতান্ত্রিক সাংবিধানিক রাষ্ট্রে। এখানে আইন লংঘনে ব্যাক্তি-মানুষকে শাস্তির মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়।

আরো পড়ুন:

মূল্য কে কি মানুষই মূল্যবান করে তোলে?

মৃত্যু: জীবনের সমাপ্তি, না অসীম যাত্রার শুরু?

Be First to Comment

    মন্তব্য করুন

    আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

    sixteen + 18 =